শাল্লার খবর ডেস্ক ::: দেশে ভূমিকম্পের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিলেট। একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। গত দুই বছরে সিলেটে অন্তত ১৫ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবেলায় সিলেটে নেই কার্যকর উদ্যোগ।
২০২১ ও ২২ সালে কয়েকদফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া সিলেটের ৬টি বিপণিবিতান বন্ধ করে দিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এগুলো ভেঙে ফেলা হবে বলেও সেসময় জানিয়েছিল সিসিক। তবে ভেঙে তো ফেলা হয়নিই, উল্টো কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের খুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানগুলো।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সংগঠিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। যার মধ্যে ১১টি হচ্ছে সিলেট অঞ্চলে। বাকি ৭টি ছিল সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার চ্যুতির লাইনগুলো সক্রিয় আছে।
এদিকে আটকে আছে সিলেটের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভূমিকম্পের সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগও। সিসিক কর্মকর্তারা জানান, অর্থের অভাবে ভবন পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না।
ফলে এখন পর্যন্ত তর্জন গর্জনেই আটকে আছে ঝুঁকি মোকাবেলার উদ্যোগ। এতে দিন দিন ভূমিকম্পে ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়ছে। সম্প্রতি তুরষ্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর আবার আলোচনায় উঠে এসেছে সিলেটের ঝুঁকির বিষয়টি।
২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরের সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা । এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নগরের বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করানো হয়।
এই বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম। তিনি বলেন, ‘সিলেটের ভবনগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিভাবে। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধকভাবে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই-চারটি ভবন নয়, বরং নগরের সবগুলো ভবন একসঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’
বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। ওইদিনই নগরের সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানসন ও রাজা ম্যানসন নামের ৭টি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময়ে নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। কিন্তু অর্থ সংকটে সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। আর নির্ধারিত ১০ দিন পর কোনো সংস্কার ছাড়াই খুলে দেয়া হয় বন্ধ করা ভবনগুলো। এখনও এগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শোনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।’
৪২ হাজার ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ প্রসঙ্গে নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা নগরের ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপও করি। ওই প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে নগরীর ৪০ থেকে ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই। তাই এখনও আমরা এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ভবন পরীক্ষার টাকা সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদেরই দেওয়ার কথা। কিন্তু কেউই টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। এখন সিটি করপোরেশনের পক্ষে এই খাতে এত টাকা ব্যয় অসম্ভব।’
সিসিক সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে আরেকবার নগরের বহুতল ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখনও মাঝপথেই আটকে যায় সে উদ্যোগ।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, নগরীর ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করা গেলে কয়েকশত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এগুলো ধসে পড়ে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ২০২১ সালের মে মাসে নগরের জিন্দাবাজার এলাকার রাজা ম্যানসন বন্ধ করে দিয়েছিল সিটি কর্তৃপক্ষ। তবে কিছুদিন পর তা আবার চালু হয়। ভবনের ভেতরে খোলা আছে সব দোকানই। চলছে বেচাকেনা।
রাজা ম্যানসন ব্যবসায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক বলেন, ‘২০১৬ সালে অনেকটা অনুমান করে মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছিল। তবে পরে বিভিন্ন জরিপ ও পরীক্ষা করে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ভবনটি রেক্টোফিটিং করে এর স্থায়িত্ব বাড়ানো যাবে। সয়েল টেস্টের পরীক্ষাও মার্কেটের অনুকূলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মার্কেটটি বন্ধ করে দেয়ার পর আমরা ভবন সংস্কার করি। সংস্কারের পর এটি চালু হয়েছে। ফলে এখন আর তেমন ঝুঁকি নেই।’
সিলেটের অনেক ভবনেরই অনুমোদন নেই জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, সিলেটের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা বলেন, ‘সিলেটের অনেক বহুতল ভবনই নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদনহীনভাবে। অলিগলির রাস্তাও সরু। ফলে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। এ ব্যাপারে নগর কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।’