শাল্লার খবর ডেস্ক :::
সিলেটকে প্রথম ডিজিটাল নগর হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু হয়েছিল ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্প’, তবে এর কাজ শেষ হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে উদ্যোগ। এখন এ প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী।
প্রকল্পের আওতায় নগরের ১২৬ পয়েন্টে চালু করা ফ্রি ওয়াইফাই সেবা বন্ধ হয়ে পড়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো সিলেট নগরের ১১০টি পয়েন্টে লাগানো চেহারা ও যানবাহনের নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণে আইপি ক্যামেরার বেশির ভাগও নষ্ট হয়ে গেছে। আর ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অটোমেশনের কাজ এখনও শেষ হয়নি।
সিলেটকে ডিজিটালাইজ করতে ২০১৮ সালে শুরু হয় ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্পের কাজ। এর শুরুতে ১১টি উদ্যোগের প্রস্তাব ছিল। পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশির ভাগ বাদ দিয়ে শুধু তিনটি উদ্যোগ প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়।
উদ্যোগগুলো হলো এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্বাস্থ্য তথ্য অটোমেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সড়কে চেহারা ও নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণ ক্যামেরা স্থাপন এবং ফ্রি ওয়াইফাই হটস্পট।
আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ওসমানী মেডিক্যালের স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা অটোমেশন হয়নি।
এখনও ‘হেলথ ম্যানেজমেন্ট অটোমেশন সিস্টেম’-এর সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৪ সালের জুন নাগাদ এটি শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মিলছে না ওয়াইফাই সেবা
প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে নগরের ৬২টি এলাকার ১২৬টি পয়েন্টে ফ্রি ওয়াইফাই সেবা চালু করা হয়। প্রকল্পের কাজ শেষে ফ্রি ওয়াইফাই সেবা ব্যবস্থাপনার জন্য ২০২১ সালের মার্চে সিলেট সিটি করপোরেশনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়, তবে হস্তান্তরের বছরখানেকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়ে এ সেবা। বর্তমানে নগরের কোনো জায়গা থেকে বিনা মূল্যে ওয়াইফাই সেবা মিলছে না।
ক্যামেরা নষ্ট
‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্পের আওতায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নগরের বিভিন্ন সড়কে বসানো হয়েছিল ১১০টি চেহারা ও গাড়ির নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণ ক্যামেরা। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ক্যামেরার বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।
সিলেট মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, ১১০টি ক্যামেরার মধ্যে ৬৮টি নষ্ট হয়ে গেছে; সচল আছে ৪২টি। বেশির ভাগ আইপি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘নগরীতে আইপি ক্যামেরা স্থাপনের পর অপরাধী শনাক্তে বেশ সুবিধা হয়েছিল। এর মধ্যে কিছু ক্যামেরায় ৩৬০ ডিগ্রি জুমিং সুবিধা রয়েছে। এসব ক্যামেরা ব্যবহার করে কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনেও সক্ষম হয় পুলিশ, কিন্তু এখন বেশিরভাগ ক্যামেরা নষ্ট হওয়াতে অপরাধী শনাক্ত কঠিন হয়েছে।’
ফ্রি ওয়াইফাই সেবা বন্ধের কারণ হিসেবে সিলেট সিটি করপোরেশন বলছে, আর্থিক সমস্যার কারণে তারা বিনা মূল্যে ওয়াইফাই সেবা দিতে পারছে না।
ফ্রি ওয়াইফাই সেবা চালুর পর ওই প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মধুসূদন চন্দ বলেছিলেন, প্রতিটি এক্সেস পয়েন্টে একসঙ্গে অন্তত ৫০০ জন বিনা মূল্যে ওয়াইফাই ব্যবহার করতে পারবেন। এর মধ্যে ১০০ জন উচ্চগতির ইন্টারনেট পাবেন। প্রতিটি এক্সেস পয়েন্টের চার দিকে ১০০ মিটার এলাকায় ব্যান্ডউইথ থাকবে প্রতি সেকেন্ড ১০ মেগাবাইট।
শুরু থেকেই ইন্টারনেটের মন্থর গতি নিয়ে অভিযোগ ছিল ব্যবহারকারীদের। গতি ধীর হলেও প্রায় সব এলাকা থেকে বিনা মূল্যে ওয়াইফাই সুবিধা পাওয়া যেত, তবে এই সেবাও এখন মিলছে না।
রোববার নগরের আম্বরখানা, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার এলাকায় ওয়াইফাই জোনে গিয়ে একাধিবার ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের চেষ্টা করেও তা ব্যবহার করা যায়নি। নির্ধারিত ইউজার নেম ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও পাসওয়ার্ড ‘জয় বাংলা’ দেয়ার পর শুধু ওয়াইফাই কানেক্ট হয়, তবে ইন্টারনেন্ট ব্যবহার করা যায় না।
নগরের আম্বরখানা এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফ আহমদ বলেন, ‘চালুর পর কিছুদিন আমরা ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পেরেছিলাম, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এটি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না, তাও জানি না।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার পর ওয়াইফাই সেবা বিকল হয়ে পড়া নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আলম বলেন, ‘সিসিকের বাজেট স্বল্পতার কারণে এ খাতে কোনো বরাদ্দ না থাকায় ইন্টারনেটের বিল দেয়া যাচ্ছে না। তাই ওয়াইফাই হটস্পটে ইন্টারনেট সংযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সাথে আমরা কথা বলেছি। তারা মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকার মতো বিল চেয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া গেলে আবারও ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হবে।’
এই প্রকল্পের অধীনে নগরে উন্নত প্রযুক্তির ১১০টি ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা বসানো হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে চেহারা ও গাড়ির নাম্বার প্লেট চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা ছিল। ২০১৯ সালের জুনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এগুলোর উদ্বোধন করে। ক্যামেরাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বসানো হয় সিলেটের কোতোয়ালি থানায়। আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল সিলেট মহানগর পুলিশ।
এসব ক্যামেরার বেশিরভাগই বিকল হয়ে পড়া নিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, ‘আমাদের কাছে হস্তান্তরের আগেই সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজের জন্য ৮০টির মতো ক্যামেরা কিংবা ক্যামেরার ফাইবার অপটিকস সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা নিজস্ব বাজেটে ৫০টির মতো ক্যামেরা ও সংযোগ চালু করেছি, কিন্তু নবায়ন ফি পরিশোধ না করায় ফেস ও নম্বর প্লেট রিকগনিশন সফটওয়্যার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।’
পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ‘এ খাতে বিশেষ বরাদ্দের জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেছি।’
কেবল উন্নয়নকাজের জন্য নয়, সিসিটিভি ক্যামেরার অনেক যন্ত্রপাতি চুরিও হয়ে গেছে জানিয়ে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো মাসে তিনবার নষ্ট হয়। ক্যামেরা ও তার সংযোগ লাইন বারবার চুরি হয়ে যায়, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা চোরকেও পুলিশ ধরতে পারেনি। এগুলো নজরদারির জন্য পুলিশের একটা বিশেষ টিম করা প্রয়োজন।’
‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ম্যানেজার (সিকিউরিটি অপারেশনস) মোহাম্মদ মহিদুর রহমান খান বলেন, ‘প্রথম দিকে প্রায় এক বছর আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিনা মূল্যে ওয়াইফাই সেবা পরিচালনা করেছিল। চেহারা চিহ্নিতকরণ ক্যামেরাও আমরা দেখভাল করেছি।
‘পরীক্ষামূলক এক বছর চালুর পর ওয়াইফাইয়ের দায়িত্ব সিলেট সিটি করপোরেশনকে ও ক্যামেরার দায়িত্ব সিলেট মহানগর পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন এগুলো দেখভালের দায়িত্ব তাদের।’