শাল্লার খবর ডেস্ক :::
ফারজানা হক মিলি। ছাত্রলীগ নেতাকে বিয়ে করেছিলেন প্রেমের সম্পর্কে। স্বপ্ন ছিলো- স্বপ্নের মানুষের হাত ধরে পাড়ি দিবেন জীবনতরী। কিন্তু মিলি জানতেন না, সেই ভালোবাসার মানুষই তাকে তিলে তিলে ঠেলে দিবেন মৃত্যুর দিকে।
সিলেট জেলা মহিলা ব্যাটমিন্টন টিমের এক সময়ের দাপুটে খেলোয়াড় ফারজানা হক মিলি’র (৩০) লাশ গত ৭ জানুয়ারি তার শয়নকক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় পান পরিবারির সদস্যরা। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।
মৃত্যুর পরই মিলির স্বজনরা দাবি তুলেন- এটি হত্যাকান্ড। পারিবারিক কলহের জেরে মিলিকে তার স্বামী পিটিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারই ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে দেহ ঝুলিয়ে রাখেন। বিবাহিত জীবনে মিলি বিভিন্ন সময় স্বামীর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বিষয়টি উঠে এসেছে মিলির মৃত্যুর পার পাওয়া তার ডায়েরি থেকে। যে ডায়েরির প্রতিটি পাতায় ছিলো মিলির জীবনের তীব্র নীল কষ্টের গল্প।
মিলির পারিবারিক সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগে মিলি সিলেটের মদন মোহন কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় অনার্স ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছাত্রলীগের সিলেটের একটি প্রভাবশালী গ্রুপের কর্মী নুর আলমের সাথে পরিচয় হয়। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার কালিয়ারকাপন গ্রামের মো. আশকর আলীর ছেলে। পরিচয়ের পর নুর আলমের ভদ্র ব্যবহারে তার প্রেমে পড়ে যান মিলি। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মিলির পরিবার বিভিন্নভাবে তাতে বাধ সাধে। এক পর্যায়ে নুর আলম ক্ষিপ্ত হয়ে জানায়, মিলিকে না পেলে তার ভাইদের মেরে ফেলবে। মিলির অতি আবেগের কারণে এক পর্যায়ে তার মা রাজি হয়ে যান। পরে সিলেট মহানগরের হাওয়াপাড়ার কাজী অফিসের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা কাবিনে মিলি ও নুরের বিয়ে হয়।
কিন্তু বিয়ের পর থেকে নুর আলমের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। তিনি স্ত্রীকে সময় না দিয়ে দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় মোবাইল ফোন নিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলায় মত্ত থাকতেন। পাশাপাশি মদ, ইয়াবা ও ফেন্সিডিলও সেবন করতো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করলেও জুয়া খেলায় সব খুঁইয়ে ফেলতেন। মাঝে মাঝে মিলিকে স্বর্ণালংকার কিনে দিলেও পরে তা জোর করে খুলে নিয়ে বিক্রি করে টাকা জুয়ায় লাগাতেন। মিলির নিজের স্বর্ণালংকারও একসময় জোর করে নিয়ে নেন নুর। এছাড়াও মিলিকে টাকা দিতে চাপ দিতেন নিয়মিত। তাই বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মিলি বিদেশ থেকে স্বজনদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা এনে স্বামীকে দিতেন।
মিলির আম্মা মৃত্যুর আগে অসুস্থ থাকাকালীন আমেরিকা থেকে ধাপে ধাপে ৮ লক্ষ টাকার বেশি মিলির একাউন্ট ও বিকাশে আসে। কিন্তু সে টাকা বেশিরভাগই মিলির কাছ থেকে নুর আলম জোর করে নিয়ে জুয়া খেলায় খুইয়ে ফেলেন।
এদিকে, মিলি ও তার বড় বোন সোহেলীর পরিবার সিলেট মহানগরের তেলিহাওস্থ সিলভ্যালি টাওয়ারের এ-টু ফ্ল্যাটে থাকতেন। একই ফ্ল্যাটে থাকায় খেলা হেরে নুর আলম প্রায় মিলিকে চাপ দিতো সোহেলীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য। মিলি এভাবে সোহেলীর কাছ থেকে পরে দিবে বলে ধাপে ধাপে কয়েক বছরে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছে। সোহেলী বোনের উপর স্বামীর অত্যাচার দেখে সহ্য করতে না পেরে টাকা হাতে তুলে দিতেন।
সবশেষে নুর আলম তার পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে ১৫ লক্ষ টাকা জুয়ায় খুইয়ে দেন। এসব বিষয় নিয়ে মিলি ও নুর আলমের প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঝগড়ার সময় মিলিকে নুর আলম অমানবিকভাবে প্রহার করতেন। মিলির বোন সোহেলী ও তার স্বামী রিপন খান নুর আলমের হাত থেকে মিলিকে অনেক সময় রক্ষা করতেন। কখনো কখনো খবর পেয়ে শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ- দেবর এসে মিলিকে রক্ষা করতেন।
জানা যায়, নুর আলমের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় হলেও তার শৈশব কাটে তার মামার বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলায়। পরে সে সিলেট নগরীর বারুতখানায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী তার মামার বাসায় বসবাস করে। সে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত হওয়ায় এক সময় মামার বাড়ির সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে। এর পর থেকে নুর আলমের ছন্নছাড়া জীবন ছিল। সে নগরীর বিভিন্ন মেসে থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতি সহ সন্ত্রাসমুলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। এই সময় কলেজে মিলির সাথে পরিচয় হলে নুর আলমের বিভিন্ন দুঃখ- কষ্ট আঁচ করে মিলি আবেগপ্রবণ হয়। মিলি নুর আলমের মা-বাবা, মামার বাড়ি ও তার নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ফের সম্পর্ক স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রাখে।
মিলির বড় ভাই সাংবাদিক আমিনুল হক সিপন জানান, প্রত্যেকটি সংসারের স্ত্রীর দায়ভার স্বামীর। কিন্তু মৃত্যুর আগে দুদিনের বেশি সময় ধরে মিলি না খেয়ে রুমের মধ্যে ছিলেন। এমনকি মিলির মরদেহ উদ্ধার পর্যন্ত নুর আলম ফ্ল্যাটে ছিলেন। একটিবারও কি তার মিলির পাশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না? দিনের পর দিন মিলির লেখা ডায়েরি, হোয়াটসঅ্যাপে তীব্র কষ্টের কথাবার্তা ও মিলির ফেসবুক প্রোফাইলের কিছু স্ট্যাটাসে প্রমাণ মিলে- এ মৃত্যর সম্পূর্ণ দায় নুর আলমের।
সিপন আরও জানান, নুর আলম জীবনে আসার পর ক্রমেই মিলি জীবনের সব ছন্দ হারাতে থাকে। ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও উচ্চশিক্ষা নেওয়া থেকে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। মৃত্যুর পর পুলিশ মিলির মোবাইল চেক করে হোয়াটসঅ্যাপে স্বামী নুর আলমের সাথে কথোপকথনের বেশ কিছু ম্যাসেজে দেখে এবং সেগুলোর স্ক্রিনশট নেয়। এসব ম্যাসেজে মিলি আবেগ দেখালেও নুর আলমের দুর্ব্যবহারের চিত্র ফুটে উঠে। মিলির মৃত্যুর এক বছর আগ থেকে নুর আলমকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি ডায়েরিও উদ্ধার করে পুলিশ। সে ডায়েরিতে নুর আলম কর্তৃক অনেক নির্যাতনের কথা উঠে এসছে এবং একদিন হয়তো মারা যাবে- এমন কথাও মিলি লিখে রেখে গেছে। ডায়েরিটি মিলির ওয়ারড্রবে কাপড়ের ভিতর লুকানো অবস্থায় ছিলো।
গত ৭ জানয়ারি সিলভ্যালি টাওয়ারের ওই ফ্ল্যাটের মিলির শয়নকক্ষ থেকে ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে ফাঁস দেওয়া ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময়ই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার স্বামীকে আটক করে পুলিশ। পরদিন মিলির বড়বোন সোহেলী বাদি হয়ে নুর আলমকে আসামি কোতোয়ালি থানায় আত্মহত্যা প্ররোচণা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আলমকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করলে বিচারক দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে।
জিজ্ঞাসাবাদে নুর আলম পুলিশকে জানায়, মিলির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে মৃত্যুর একদিন আগে রাতের বেলা মিলিকে অত্যাচার করেন তিনি। ওই রাতে কিছুক্ষণ পরপর গ্লাস দিয়ে মিলির শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালেন তিনি।
সেই নির্যাতনেইর ফলেই মিলি মারা গেছেন বলেন তার পরিবারের দাবি।
এদিকে, মামলার এজাহারে বাদি সোহেলি অভিযোগ করেন- গত ৪ জানুয়ারি মিলিকে তার স্বামী ৫ হাজার টাকা দিতে বললে তিনি অপরাগতা জানান। তখন স্বামী নির্মমভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে মিলিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেন।
নির্যাতন সইতে না পেরে ৫ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মিলি তার রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে সোহেলী দরজা খোলার চেষ্টা করতে নূর আলমকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে নূর আলম কর্ণপাত করেনি। একপর্যায়ে সোহেলী তার স্বামী রিপন খানকে ফোন দিয়ে এনে দরজা খোলার উদ্যোগ নিলে তাতেও নূর আলম বাধা দেন। এই অবস্থায় ৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে মিলির ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান।
মিলির বোন সোহেলী জানান, আল্টাসনোগ্রামের রিপোর্ট অনুযায়ী- একবছর আগে অন্তঃসত্ত্বা ছিলো মিলি। ওয়েসিস মেডিকেল থেকে জানানো হয়- মিলির গর্বে দুটি বাচ্চা আছে। এমন সুসংবাদ পেয়ে আমরা সবাই খুব খুশি হই। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে মিলির গর্ভধারণের বিষয়টি প্রমাণ হয়। কিন্তু জুয়ার টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে নুর আলম মিলিকে মারধর করে মিলির গর্ভের সন্তান দুটি নষ্ট করে দেয় নুর।
সোহেলী আরো জানান, মিলি রাগ করলে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে দু-তিনদিন রুমের দরজা লাগিয়ে রাখরতো। এটা তার পুরনো অভ্যাস। কিন্ত সেদিন মিলি বেশি হলে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাতে পারে। মরতে পারে না। ইচ্ছে করে মরলে সে আমাকে একটা কিছু বলতো কিংবা কোনো কিছুর সমাধানও দিয়ে যেত। আমার পাওনা টাকা সম্পর্কে ও কিছু বলতো।
তিনি আরও বলেন, মিলির রুমের দরজা ও থাইগ্লাস লক অবস্থায় নুর আলম কয়েকবার বাসা থেকে আসা- যাওয়ার শব্দও তিনি রুম থেকে শুনতে পান। মিলি শব্দ না করায় দরজা ভাঙার জন্য আমার স্বামীকে ফোন দিলে নুর আলম তার রাজনৈতিক সঙ্গীদের ফোন দিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। এসময় তারা ‘একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে’ বলে পুলিশকে জানায়।
মিলির ভাই ব্যবসায়ী জহিরুল হক মিলন বলেন, পুলিশ এসে আমার বোনের মরদেহ বিছানায় হাঁটু ভাঙা অবস্থায় পায়। এছাড়া তার শরীরে আঘাতের চিহ্নও ছিলো।
তিনি আরও বলেন, একজন মানুষ ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলে কিছু নির্দিষ্ট আলামত থাকে। কিন্তু আমার বোনের মরদেহে তা ছিলো না। এছাড়া ঝুলন্ত লাশের হাঁটু পর্যন্ত বিছানায় ছিল। একটা মানুষ মৃত্যুর পর্যায়ে পৌঁছলে বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু তার হাঁটুর পাশে থাকা মুড়াটি পর্যন্ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলো।