বিশেষ প্রতিনিধি: শাহীদ আলী মডেল পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফ মোহাম্মদ দুলালের বিভিন্ন অনিয়ম-দূর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য-উপাত্ত৷ তবে অনুসন্ধানের সবগুলো কথার রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রধান শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতি:
প্রধান শিক্ষক আরিফ মোহাম্মদ দুলাল ২০১৩ সালে নিয়োগ হয়েছিল দুর্নীতি করে। সে ছিল যুবলীগের সাবেক শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা অবনী মোহন দাশের মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় দুলাল। কারন অবনী বাবু ছিলেন ঐ স্কুলের সভাপতি। প্রধান শিক্ষক দুলাল তার নিজ স্বার্থে পছন্দের মানুষকে কমিটিতে রাখতেন। পরবর্তীতে অধিকাংশ কমিটির সদস্যদের দ্বারা যেকোন কৌশলে অবনী বাবুকে সভাপতি নির্বাচন করতেন। বিগত এক দশক যাবত সরকার পতনের পূর্ব পর্যন্ত অবনী বাবু ছিলেন একটানা স্কুলের সভাপতি। প্রধান শিক্ষক দুলাল দূর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে নিজেই দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, স্কুলের দৃশ্যমান আয়ের উৎস থাকলেও ব্যয়ের হিসাব অদৃশ্য। বিগত ১০ বছর যাবত কোন অডিট হয়নি, এছাড়াও আরো অনেক অর্থ কেলেঙ্কারি আছে। এগুলোর বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে এমনটাই দাবী করেন একাধিক মানুষ।
সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি ও মামলা:
এই স্কুলে আসার আগে দুলাল ছিলেন হাফিজ আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ঐ স্কুলের সভাপতি ছিলেন শাল্লা কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদ। তারা দু’জন সম্পর্কে মামা-ভাগ্না। তার মামা সভাপতি প্রিন্সিপাল শহীদের স্বাক্ষর জাল করে ছাড়পত্র নিয়ে দুলাল শাহীদ আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। এ নিয়ে প্রিন্সিপাল স্বাক্ষর জালিয়াতির মামলাও করেছিল এটা সবাই জানে। পরে বড় বড় নেতারা মিলে আপোষ করে। শুধু তাই না, দুলাল নতুন যে বাসা তৈরি করতেছে এই স্কুলের মালামাল নিয়া। মালামাল কিনে নিচ্ছেন নাকি এমনি ? প্রতিত্তোরে তিনি বলেন কিনে নেয় নি এমনি নিচ্ছে। আপনি কি নিশ্চিত ? উনি আরো উচ্চস্বরে বলেন হ্যা আমি নিশ্চিত এমনভাবেই মন্তব্য করেন স্কুল প্রতিষ্ঠাতার সন্তান মন্নান মিয়া।
প্রিন্সিপাল আব্দুস শহীদকে একাধিক বার কল দিলে নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। পরে উনার অফিস সহকারী সুমনকে বললে স্যার অফিসে নাই বা অন্যকোন নাম্বার আছে কিনা জানতে চাইলে সুমন বলেন, স্যার সিলেট চলে গেছে এই নাম্বার বন্ধ হলে অন্য কোন নাম্বার আমার কাছে নাই।
ছাত্র টর্চারের মামলায় শিক্ষক যান জেলে:
প্রধান শিক্ষক দুলাল নিয়োগের কিছুদিন পরেই ছাত্রকে অনৈতিক টর্চার করায় ছাত্রের বাবা হরিপদ সরকার বাদী হয়ে একটা মামলা করেছিলেন। যার মামলা নং-০৯, জিআর-৭০, তারিখ-২৪/০৮/২০১৪ ইং। ঐ মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটেন। তবে মামলার বাদী মৃত্যুবরন করায় বর্তমানে মামলার বিষয়ে আর কিছু জানা যায় নি। জেলে থাকাকালীন সময় স্কুলের সভাপতি অবনী বাবুকে ম্যানেজ করে বেতন ভাতা উত্তোলন করেছিলেন বলে জানাযায় বিশ্বস্ত সূত্রে।
আবাসিক ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল না দেওয়া:
স্কুলের হোস্টেলে পরিবার নিয়ে অবস্থানকারী শিক্ষকরা আবাসিক ভাড়া পরিশোধ করলেও প্রধান শিক্ষক দুলাল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোন ভাড়া পরিশোধ করেন নাই। বাসার ব্যক্তিগত কাজে বিদ্যুৎ বিল ও পানি বিল স্কুলের মিটার থেকে পরিশোধ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে বিল্ডিং বিক্রি:
স্কুলের পুরাতন বিল্ডিং নিলামে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে শিক্ষক দুলাল নিজেই লোক দিয়ে স্কুল ভেঙ্গে মালামাল বিক্রি করেন। একজন নিলাম ক্রেতা বলেন, আমি পুরান একটা বিল্ডিং কিনার জন্য ২ লক্ষ টেকা কইছি, কিন্তু দুলাল স্যার কয় আমি নিজেই বিল্ডিং ভাঙ্গব। নিলাম ডাকছিলেন কিনা বললে তিনি জানান নিলাম ডাকা হয়নি। পরে ডুমরার রঞ্জনরে দিয়ে বিল্ডিং ভাঙ্গছে। রঞ্জন মুঠোফোনে জানায়, আমরা দেড় লক্ষ টাকায় বিল্ডিং ভাঙ্গার কন্ট্রাক্ট নেই। ওপেন টেন্ডার দেয়নি। তবে মালামাল গুলো দুলাল ভাই নিজেই বিক্রি করছেন। মালামাল সাড়ে ৩ লক্ষ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। আওয়ামিলীগের নেতা এবং স্কুলের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিল বিধায় নিলাম দেয়নি। এর আগেও একটা বিল্ডিং বিক্রি করছে ৫০ হাজার টাকায় এই বিল্ডিংয়ের চেয়ে ঐটা আরও বড় ছিল। অদ্য ছাত্রদের হোস্টেল টীনশেডের একাংশ আবার ওপেনলি নিলাম দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। নিলাম ডেকেই ২লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন সহদেব পাশার বেদন মিয়া ছেলে সোবেল মিয়া।
এ ব্যাপারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্কুলের সভাপতি অবনী মোহন দাশ মুঠোফোনে বলেন, প্রধান শিক্ষক দুলাল নিয়োগের বিষয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন করলে উনি আপাতত কোন মন্তব্য করতে ইচ্ছুক নয়।
এই প্রসঙ্গে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে জানান, শাহীদ আলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক দুলালের প্রতি সমস্ত মানুষ অতিষ্ঠ এটা সবাই জানে। পুরাতন বিল্ডিং বিক্রি বা নিলামের বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। কেন জানেন না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন এই উত্তর আমার কাছে নাই। অবনী বাবু বহুদিন ধরে সভাপতি, বেসরকারি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অল ইন অল। অনেক সময় নির্বাচন না করেই তারা কমিটি গঠন করে। এই কমিটি চাকরি দিতেছে আবার চাকরি খাইতেছে আমার কাছে কোন ফাইল পাঠাইলে আমি অবগত হই। যেকেউ ডিসি স্যারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে এবং আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমি এডিসি স্যারের সাথে কথা বলে আমরা ব্যবস্থা নিব।
প্রধান শিক্ষক আরিফ মোহাম্মদ দুলালকে সরজমিনে না পেয়ে মুঠোফোনে একাধিক ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি, এমনকি ওয়াটসএ্যাপে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। দু’দিন পর আবার কল দিলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, একটু পর কল দিতেছি। পরে কল দেয়নি আবার উনাকে কল দিলে নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
অবৈধভাবে ক্লাসরুম ছেড়ে সরকারি আবাসনে:
তথ্যে আরো উঠে আসছে, শাল্লার ইউএনও (আলাউদ্দিন) এই রকম দুর্নীতিগ্রস্থ শিক্ষককে কিভাবে প্রশয় দিচ্ছে ? গতমাসে ছাত্ররা আন্দোলন করে অভিযোগ দিয়েছে, কিন্তু ইউএনও’র উচিত ছিল অভিযোগটিকে আমলে নিয়ে কমিটি করে তদন্ত করানো। ইউএনও সেটা না করে উনাকে সেইফ করার জন্য উনার কোয়ার্টারে নিয়েছেন। বিভিন্ন নিউজ ও সমালোচনার তোপে শিক্ষক ক্লাস রুমের বাসস্থান ছেড়ে সোজা সরকারি কোয়ার্টারে গেছেন। আসলে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সরকারি কোয়ার্টারে থাকার বিধান জানামতে নেই। তবে উনার সাথে ইউএনওর খুব গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এবিষয়ে স্কুলের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আলাউদ্দিন জানান, অভিযোগের তদন্ত টিম এখন পর্যন্ত করা হয়নি। পূজা যাক পূজার পর দেখতেছি ! কোয়ার্টার কি ঐ শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ? ইউএনও জানান, উনার জন্য কোন বরাদ্দ নাই। তাহলে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক কিভাবে সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন এমন প্রশ্নে ইউএনও প্রতিবেদকে জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে পারেন না, আমার অনুমতি সাপেক্ষে যেহেতু উনি আবেদন করছেন সেহেতু ভাড়া দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবেন। আমার জানামতে সরকারি চাকরিজীবী ১বছর পূর্বে কোয়ার্টার ভাড়া নেওয়ার জন্য আপনার দপ্তরে আবেদন জমা দিয়েছেন কিন্তু তাদেরকে না দিয়ে আপনি উনাকে ভাড়া দেওয়ার কথা বলতেই কল কেটে দেন!